আমার জন্ম পৃথিবীর এক ব্যস্ত শহরে। এখানে আমোদ, প্রমোদ, বিনোদন কোন কিছুর-ই অভাব নেই। শুধু অভাব সবুজের। এক টুকরো সবুজ দেখতে মাঝে মাঝে মনে হয় আতস কাঁচ ব্যবহার করতে হবে। সভ্যতার মুখোশ লাগিয়ে, উন্নয়নের দোহাই দিয়ে একের
পর এক গাছের মৃতদেহ দেখছি শহরের চার পাশে। তাই বারবার ইচ্ছে হয় সবুজের মাঝে হারিয়ে যেতে। কয়েকদিন প্রাণ ভরে সবুজের শোভা দেখার জন্য প্রাণ টা হানচান করে, মনটা বড় উতলা হয়ে ওঠে। মন ছুটে চলে যেতে চায় এমন এক জায়গায় যেখানে
দুচোখ ভরে সবুজ অরন্য রাজির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারব। হঠাত করেই সেই সুযোগ টাও এসে গেল।
আমার স্কুলে সবে মাত্র যোগ দিয়েছে রিতা মাঝি। বয়সে আমার চেয়ে কিছু ছোট। মেয়েটির পড়ানোর গুনে কিছুদিনের মধ্যেই ওর প্রতি একটা ভালবাসা তৈরি হয়ে গেল আমাদের সব পুরনো শিক্ষিকাদের মনে। কথায় কথায় জানতে পারলাম মেয়েটির বাড়ি
সুন্দরবনের একটি দ্বীপে। ওই একদিন টিফিন টাইমে বলল আমাকে ওর সাথে ঘুরতে যাবার জন্য। আমরা টিফিন টাইমে চা খাচ্ছিলাম। তখন রিতা বলল, কথাটা।
-চিত্রিতা দি, একটা কথা বলব তোমায়?
-কি রে? বল না।
-তুমি সেদিন বলছিলে না, কোথাও ঘুরতে যাবে।
-হ্যাঁ রে, এই শীতের ছুটিতে ভাবছি কাছেই কোথাও ঘুরে এলে হত।
-আমার সাথে সুন্দরবন যাবে? এই শীতের ছুটিতে আমিও তো বাড়ি যাচ্ছি।
-যেতে পারি, কিন্তু তোর বাড়িতে কোন অসুবিধা হবেনা তো?
-বাড়িতে তোমার কথা বলেছি। ওনারাও বলছিলেন, তোমায় আনতে।
-ঠিক আছে যাব তাহলে।
ওর আন্তরিক আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে খারাপ লাগছিল, তাই রাজি হয়েই গেলাম। বাড়িতে প্রথমে আপত্তি করলেও পরে রাজি হয়। ঠিক হয় ২৫শে ডিসেম্বর ভোরে আমরা বেরবো। তার আগের দিন আমাদের স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। পরের দিন ভোরে, কথামত গাড়ি
নিয়ে হাজির রিতা। আমি ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। গাড়ির শব্দে বাইরে এলাম। আমাকে দেখে রিতা বলল,
-কিগো তৈরি তো?
-হ্যাঁ রে, একদম।
আমার সাথে ২টো বড় ব্যাগ ছিল। সেগুলো গাড়ির পিছনে রেখে গাড়িতে উঠলাম। অনেকদিন পর কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি। রাস্তার ধারের চেনা পরিবেশ টা কুয়াশায় আচ্ছন্ন, বেশ লাগছিল দেখতে। রিতা কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে আমি-ই কথা শুরু করলাম।
-গাড়ি টা কে ঠিক করল?
-আমার গ্রামের একজন এখানে গাড়ি চালায়। ওই গাড়ি টা ঠিক করে দিয়েছে। ওর চেনা গাড়িতে করেই আমি আসা যাওয়া করি।
-লঞ্চ ঘাট যেতে কতক্ষণ লাগবে রে?
-৩ ঘণ্টায় পোঁছে যাব।
ইঁট কাঠ পাথরের সবুজ হীন আমার প্রিয় শহর ছেড়ে গাড়ি অনেক টা দূরে চলে এসেছে। বেশ একটা সবুজের ছোঁয়া রয়েছে চারধারে। গাড়ি থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখি ১টা সাপ ঝোপঝাড়ের মধ্যে শুয়ে আছে। আমার ক্যামেরার স্মৃতি তে ভরে নিলাম তাকে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর, আমি আবার কথা শুরু করলাম। প্রশ্ন করলাম, রিতা কে।
-আচ্ছা, আমায় একটা কথা বল, তুই আমায় তোর বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলি কেন হঠাত? এমনি, নাকি কোন কারণ আছে?
-না তেমন কোন কারণ নেই। তবে ওখানে গেলে দেখতে পাবে গ্রামের সবুজ সরলতার মাঝে কুসংস্কার আর কুশিক্ষার বিষাক্ত ছোবল আমার এই সবুজ গ্রাম টা কে কেমন কুরে কুরে খাচ্ছে। জানো, আমার এসব দেখে খুব কষ্ট হয়।
মনে মনে ভাবলাম, ছোবল আমার শহরেও আছে, দূর থেকে সভ্য, আধুনিক, শিক্ষিত যে শহর টাকে মনে হয়, তার ওপরও ছোবল আছে অর্থলোলুপ কিছু মানুষের, যারা প্রতিনিয়ত টাকার জন্য এই শহরের বুক থেকে সবুজ কে নিংরে নিচ্ছে।
পথের দু ধারের সবুজ স্মৃতি আমার ক্যামেরায় বন্দী করতে লাগলাম। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম গদখালি লঞ্চ ঘাট। এবার জলের মাঝে ভেসে চলা। লঞ্চ থেকে দেখতে লাগলাম নীল জল আর চার ধারের সবুজ উদ্ভিদ রাজ্য। মনে হচ্ছিল শহরের বড় শপিং মল,
মাল্টিপ্লেক্স এসব নিয়ে যতই গর্ব করি, আমরা আসল জিনিষ গুলো থেকেই বঞ্চিত। তা হোল প্রকৃতির নির্মল সবুজ সৌন্দর্য। দেখতে দেখতে প্রায় বিকেল ৩ টে নাগাদ পৌঁছে গেলাম সেই মহা সবুজের রাজ্যে, সুন্দরীর দ্বীপ সুন্দরবনে। শীতের বিকেল, সূর্য টা সারাদিন
পৃথিবী কে উত্তাপ দান করে তখন খুব ক্লান্ত, তাই যাই যাই করছে। রিতার বাড়িতে ওর বাবা, মা আর ভাইয়ের সাথে আলাপ করে খুব ভাল লাগল। এত আন্তরিকতা আমার এই দীর্ঘ জীবনে আমার শহরের কজন মানুষের মধ্যে দেখেছি আমি বলতে পারবনা।
রিতা জানালো পরের দিন ভোরে ব্যাঘ্র প্রকল্প গুলো ঘুরতে যাব। মন টা খুশী তে ভরে গেল। মনে মনে ভোরের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। পরের দিন কাক ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এত ভোর কখনও দেখিনি নিজের শহরে। বেশ একটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে ছিল এই
কুয়াশা ঘেরা সবুজময় পরিবেশে। ব্যাঘ্র প্রকল্প গুলো ঘুরে সন্ধ্যের মধ্যেই ফিরে এলাম। সুন্দরী, গরাণ, গেঁওয়া আর হাজার রকমের উদ্ভিদের আকর্ষণ আর অনাবিল আহ্বান আমায় ঘিরে রেখেছিল, আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। প্রকৃতি সেখানে দু হাত বাড়িয়ে আমাদের
আলিঙ্গন করছে। মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখলাম, চারদিকে শুধু সবুজ, সবুজ আর সবুজ। প্রকৃতির রুপ দেখতে মগ্ন হয়ে গেলাম। পরের দিন ফিরে আসতে হবে ভেবে মনটা উদাস হয়ে গেল। আবার সেই কর্ম ব্যস্ত শহরে ফিরে আসতে হবে। চলে আসার দিন
ভোরবেলা রিতার সাথে গ্রাম টা ঘুরতে গেলাম। যেতে যেতে রিতা বলল,
-তোমায় আজ একজনের সাথে আলাপ করিয়ে দেব।
-কে রে?
-আছে একজন, চলই না, দেখতে পাবে।
-তোদের এই গ্রাম টা খুব সুন্দর রে, এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না।
হাঁটতে হাঁটতে চলেছি দুজনে। দেখলাম দু ধারের ধান খেত থেকে ধান কাটা হয়ে গিয়েছে, পড়ে আছে ফাঁকা জমি। ইচ্ছে করছিল ছুটে যাই ওর ভিতর দিয়ে। ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশ, পাখীর ডাক, মন জুড়িয়ে গেল। এক অনাবিল আনন্দে ছেয়ে গেল হৃদয়। দেখতে
দেখতে আমরা একটা ছোট মাটির বাড়ির কাছে এসে পৌঁছলাম। রিতা ভিতরে গিয়ে নাম ধরে ডাকতে লাগল।
-রাঙা কাকিমা, আছো নাকি?
-কে রে? রিতা নাকি?
একজন বয়স্কার গলা শোনা গেল ভেতর থেকে।
-হ্যাঁ আমি গো।
রিতা উত্তর দিল।
রিতার সাথে আমি মাটির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে একজন বছর ৫০-এর মহিলা। রিতা আমার সাথে ওনার পরিচয় করিয়ে দিল। উনি আমাকে উঠোনে বসতে বললেন। রিতা জিজ্ঞেস করলো,
-নূপুর নেই কাকিমা?
-এই তো কাছেই কারোর বাড়ি গেছে চলে আসবে। তুই বসনা। বলনা তোর নতুন স্কুল কেমন চলছে?
আমি বাড়ির আশপাশ টা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। উঠোনে একটা কুল গাছ চোখে পড়ল। পাশে একটা লেবু গাছ। লেবু ফুলের গন্ধে ভরে আছে পারিবেশ। হঠাত একটা বাচ্চা মেয়ের গলা শুনতে পেলাম। রিতার গলা শোনা গেল, আমাকে ডাকছে।
-ও চিত্রিতা দি, এদিকে এসো।
-কি হয়েছে রে?
দেখি বাচ্চা মেয়েটি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। রিতা বলল এই নপুর, এর কথাই তখন তোমাকে বলছিলাম।
-আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম তোমার নাম নূপুর?
-হ্যাঁ।
ও বলল।
-বাহ খুব সুন্দর নাম তো তোমার, তুমি নাচতে পার?
-না।
মেয়েটি হেসে বলল।
মহিলা টি বললেন,
-এ আমার নাতনি। আমার মেয়ের মেয়ে।
রিতা বলল,
-কি রে, নতুন পিসি কে তোর মায়ের সাথে দেখা করাবি না?
নূপুর আমার হাত ধরে নিয়ে গেল ওর বাড়ির পিছন দিকে। যেখানে একটু আগেই আমি ঘুরে দেখছিলাম। সাথে রিতা আর রাঙা কাকিমা-ও এলেন। নূপুর একটা সবেদা গাছ কে দেখিয়ে বলল,
-জানো পিসি এটা আমার মা।
দেখলাম গাছ টা সুন্দর করে একটা শাড়ী দিয়ে ঘেরা।
রাঙা কাকিমা বলল,
-ওর যখন দু বছর বয়স, তখন ওর মা মারা যায়। এই গাছ টা ওর মা পুঁতেছিল ওর জন্মানোর পর। তাই ও যখন একটু বড় হোল তখন ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে, আমরা বলি ওটা তোর মা। তাই ও গাছ টা কে ওর মায়ের একটা শাড়ী পড়িয়ে রেখেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-ওর বাবা নেই?
রাঙা কাকিমা বললেন
-ওর বাবা আবার বিয়ে করেছে, তাই ও এখন আমার কাছেই থাকে। ওর বাবা আগে আসত, এখন আর আসেনা।
গাছের ওপর দিকে তাকালাম। এক টুকরো রোদ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আমার মুখে এসে পড়ল। কি নির্মল, স্নিগ্ধ সেই রোদ, ঠিক যেন কোন মায়ের স্নেহস্পর্শ। দেখি গাছের সেই স্নিগ্ধ ছায়া টার ওপর দাঁড়িয়ে নূপুর। এবাভেই বোধ হয় মায়ের ভালবাসা মেয়ে
কে ছুঁয়ে যায়। নুপুরের সেই নিষ্পাপ মুখ টা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল সেদিন ওর জন্য। ব্যগ থেকে কিছু ক্যাডবেরি বার করে দিলাম ওকে।
-ওর বয়স কত এখন?
আমি জিজ্ঞেস করলাম রাঙা কাকিমা কে।
-৫
-ও পড়াশোনা করেনা?
-পড়ে, কিন্তু বেশী পড়ানোর সামর্থ্য তো আমার নেই।
নুপুরের জন্য রাঙা কাকিমা কে কিছু টাকা দিলাম, চলে আসার সময়, যদিও জানি ওতে কিছু হবেনা।
নুপুরের সবুজ হৃদয় আমাকে মুগ্ধ করেছিল। বৃদ্ধাশ্রমের জুগেও এমন ভালবাসা দেখা যায়, ভাবতে ভাল লাগে। একজন বাবা তার, জীবিত মেয়ের কোন খোঁজ রাখেনা, আর একজন মেয়ে তার, মৃত মাকে মনে প্রানে জীবিত ভেবে চলে। মিনতি দির বৃদ্ধাবাসের
অসহায় মা দের করুণ মুখ গুলো মনে পড়ে গেল। দুপুরে বেড়িয়ে পরলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। চোখের কোন বোধ হয় একটু ভিজে গেল নিজের অজান্তে। মন কে প্রশ্ন করলাম, কার জন্য। নুপুরের ভালবাসা, কিছু মানুষের হৃদয় হীনতা নাকি এই সবুজ শ্যমল
পরিবেশ। তারপর সব পিছনে ফেলে অবশেষে সন্ধ্যা বেলায় সবুজ দ্বীপ থেকে সবুজ স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম আমার সেই প্রিয় শহরের কাছে।